বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন হত্যার তদন্ত নিয়ে র‌্যাব-ডিবিতে যা হচ্ছে

জাগো বাংলা ডেস্ক প্রকাশিত: ০৮:৩৫ এএম, ১৯ নভেম্বর ২০২২
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন হত্যার তদন্ত নিয়ে র‌্যাব-ডিবিতে যা হচ্ছে

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার ‘সঠিক কারণ’ এখনও জানা যায়নি। উল্টো হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনও পর্যন্ত ভিন্ন-ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে র‌্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। র‌্যাব ‘ধারণা’র ওপর ভর করে বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ‘রায়হান গ্যাং’ সম্পৃক্ত। এই গ্যাংয়ের প্রধান রায়হান চনপাড়া বস্তির একাংশের নিয়ন্ত্রক।

সংস্থাটির দাবি, হত্যাকাণ্ডের রাতে ফারদিনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স সন্দেহে রায়হান ও তার সহযোগীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ডিবি বলছে, মাদক সংশ্লিষ্টতায় খুন হতে পারেন ফারদিন। তবে চনপাড়া বস্তিতে নয়, এই তরুণকে ঢাকার অন্য কোথাও খুন করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়া হয়।

ফারদিন নূর পরশ হত্যার মামলার মূল তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। আর এই ঘটনায় ছায়াতদন্ত করছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাব। রামপুর থানায় মামলা হওয়ার পরের দিন বিকালে ডিবি মতিঝিল বিভাগে মামলা হস্তান্তর করে থানা পুলিশ।

গত ৪ নভেম্বর বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হন ফারদিন নূর পরশ। তারপর থেকেই নিখোঁজ হন তিনি। পরে ৫ নভেম্বর তার বাবা রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। গত সোমবার (৭ নভেম্বর) বিকালে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে নৌপুলিশ। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ গণমাধ্যমকে জানান, ফারদিনের দেহে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে এটি হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার দুই দিন পর বুধবার (৯ নভেম্বর) রাতে তার বাবা নূর উদ্দিন বাদী হয়ে রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা করে। এরপরের দিন বৃহস্পতিবার মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় গোয়েন্দা পুলিশ।

এ ঘটনায় র‌্যাব ও পুলিশ যা বলছে

গত সোমবার (১৪ নভেম্বর) রাতে র‌্যাব জানায়, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চনপাড়ার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রায়হানসহ বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যারা বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। যেকোনও সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে।

এরপর গত মঙ্গল ও বুধবার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে র‌্যাব বলেছে, হত্যাকাণ্ডে কারা জড়িত; আমরা তাদের প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি। চনপাড়ার আশপাশে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে হতে পারে। আমরা অনেকটাই নিশ্চিত যে, চনপাড়ার রায়হান গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রায়হানকে যদি আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি, তাহলে ফারদিন খুনের মোটিফ বের করতে পারবো। তবে ফারদিন চনপাড়ায় কেন গিয়েছিল, সে কারণটা এখনও বের করতে পারেনি র‌্যাব।

এদিকে ফারদিন হত্যা মামলার তদন্ত কর্তৃপক্ষ ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) সাংবাদিকদের জানান, ফারদিনের চনপাড়া বস্তিতে যাওয়ার প্রমাণ এখনও মেলেনি, তাকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

ডিবি প্রধান হারুন আরও বলেন, ফারদিনের মোবাইলের ডাটা এনালাইসিস ও বিভিন্ন জায়গায় তিনি যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের কোনও এক জায়াগায় খুন হতে পারেন তিনি। মোবাইলের লোকেশনে আমরা নারায়ণগঞ্জও পেয়েছি। সবকিছু মিলিয়ে তদন্তের স্বার্থে কংক্রিট কিছু বলতে পারছি না।

তিনি বলেন, ‘আমরা এই কথা এখনই বলছি না যে, তিনি মাদকের কারণে খুন হয়েছে। অথবা এক নম্বর আসামি যাকে আমরা গ্রেফতার করেছি, সে-ই তাকে খুন করেছে— এটাও আমরা বলছি না। পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করছি। ডিবির পক্ষ থেকে আমরা কখনোই বলিনি যে, তিনি (ফারদিন) চনপাড়া গিয়ে মাদকের কারণে মারা গেছেন। আমাদের টিম সবগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করছে। আসলে কী ঘটনা তা আমরা এখনও বের করতে পারিনি।’

মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার রাত সোয়া ২টার কাছাকাছি সময়ে সবশেষ যাত্রাবাড়ী মোড়ে ফারদিনকে দেখা গেছে। সাদা গেঞ্জি পরা অবস্থায় এক যুবক তাকে একটি লেগুনায় তুলে দেয়। ওই লেগুনায় আরও চার জন ছিল। লেগুনাটি তারাবোর দিকে নিয়ে যায়। ওই লেগুনার চালক ও সহযোগীদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’

ফারদিন হত্যা ‘নারীঘটিত কারণে’ নয়

বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার পরে প্রথমে ‘নারীঘটিত কারণে’ বলে মনে করা হলেও ধীরে ধীরে তা অন্য দিকে মোড় নিতে শুরু করে। শুরুতেই ‘নারীঘটিত কারণ’ সন্দেহে ফারদিনের বান্ধবী বুশরাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে বুশরা পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষ কারাগারে আছেন।

অন্যান্য বিষয়ে অমত থাকলেও একটি বিষয়ে দুই সংস্থাই একমত যে, এই ঘটনায় বুশরার কোনও সংশ্লিষ্টতার তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

তদন্ত সংস্থা দুটি এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের কোনও আলামতও উদ্ধার করতে পারেনি। সংস্থা দুটি ফারদিনের মোবাইল ফোনের সর্বশেষ লোকেশন, কল লিস্ট আর সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই ঘটনার পর্যালোচনা করে যাচ্ছে। তবে গোয়েন্দা সদস্যরা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা আশাবাদী যে, তারা এই হত্যাকাণ্ডের মূল ঘটনা সম্মুখে নিয়ে আসবেন।

দুই সংস্থার কর্মকর্তারা যা বলছেন

এ বিষয়ে জানতে শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তিনি বলেন, ‘এবিষয়ে নতুন করে কোনও অগ্রগতি না থাকায় কোনও মন্তব্য করতে পারছি না, তবে তদন্ত চলছে। আমরা ধারণা করছি, রায়হান গ্যাং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।’

পরে বিষয়টি জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকে ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

মাদকসংশ্লিষ্টতার কথা প্রত্যাখ্যান ফারদিনের বাবার

ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে কখনও সিগারেটের ধোঁয়া পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না। এই ছেলে হঠাৎ কেন মাদকের স্পটের দিকে যাবে- এটা আমার কোনোভাবেই মাথায় আসছে না।’

তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বলেন, ‘আমি শুধু চাই আমার ছেলে হত্যাকরীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, এখন আর কোনও চাওয়া নেই।’

সিসিটিভি ফুটেজে যা আছে

নিহত ফারদিনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে তদন্ত সংস্থা বলছে, হত্যাকাণ্ডের দিন ফারদিনের সর্বশেষ ফোনের লোকেশন ছিল রাত ২টা ৩৫ মিনিটে চানপাড়া বস্তির ৬নং ওয়ার্ডের একটি জায়গায়। সেদিন রাতে চানপাড়া বস্তিতে কয়েকজন যুবকের সন্দেহজনক ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। লাশ উদ্ধার হওয়া ওই এলাকায়। এমন একটি সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করছে তদন্ত সংস্থাগুলো। সেখানে দেখা যায়, ঘটনার দিন (৪ নভেম্বর) রাতে ছয় যুবক ১টা ২৮ মিনিট চনপাড়া বস্তির ৬নং ওয়ার্ডের ৬নং গলি থেকে বের হয়ে, চানপাড়া-রূপগঞ্জ সড়কে উঠে ১নং ওয়ার্ডের দিকে চলে যায়। তার ঠিক ২৩ মিনিট পরে ওই গলিতে আবার ফিরে আসে। পরে ২টা ২৩ মিনিট পর একই গলিতে তাদের কাছে আসে আরও চার যুবক। ওই সময় তদের সবাইকে উদ্বিগ্ন দেখায়।

এছাড়া ২টা ৫২ মিনিটে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার সেখানে আসে। ৬নং ওয়ার্ডের ফারদিন হত্যাকাণ্ডের এলাকার দিকে যায়। ১০ মিনিট পরে প্রাইভেটকারটি ওই গলি পার হয়ে প্রধান সড়ক ধরে শীতলক্ষা নদীর বালু ব্রিজীর দিকে চলে যায়। তবে ওই গাড়িতে ফারদিনের মরদেহ ছিল কিনা সেটা নিশ্চিত হতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু গাড়ির ভেতরে কয়েকজন যুবক ছিল সেটা নিশ্চিত হয়েছে তারা।

ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের আনুষ্ঠানিক তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আর ঘটনার ছায়াতদন্ত করছে র‌্যাব। তদন্তকারীরা দুটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করছে। সেটা হলো- ওই বস্তিতে ফারদিন যাওয়া পরে মাদক কারবারীদের কবলে পড়েন। আর না হয় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। কিন্তু দুটি ঘটনার যায় হোক এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন রায়হান গ্যাং বলে সন্দেহ করছে র‌্যাব। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে রায়হান গ্যাং। রায়হান গ্যাংয়ের অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি বিশ্লেষণও করা হচ্ছে।

দুই সংস্থার ‘ভিন্ন তথ্যে’ যা বলছেন সাবেক আইজিপি

একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিষয়ে এমন ভিন্ন-ভিন্ন তথ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ বিষয়ে সমাধন কী— জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহিদুল ইসলাম বলেন, ফারদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মূল তদন্ত সংস্থা ডিবি। এঘটনায় তাদের জবাবদিহিতা বেশি। আর এই ঘটনায় র‌্যাব ছায়াতদন্ত করতেই পারে। কিন্তু তাদের সেই তদন্ত রিপোর্ট মিডিয়াতে না আনাই ভালো।

তিনি বলেন, ‘ডিবি হোক আর র‌্যাব হোক, কেউ পয়েন্ট নেওয়ার জন্য সব মিডিয়াতে দেবে; এটা ঠিক না। কোনও ঘটনার একটা গ্রহণযোগ্য অগ্রগতি হবে, তখন সেটা মিডিয়াতে আসবে। এছাড়া মিডিয়ায় বলতে হবে আমরা তদন্ত করছি, কোনও গ্রহণযোগ্য তথ্য পেলে জানাবো। তা না হলে এতে বিভ্রান্ত সৃষ্টি হয়।’

‘ছায়াতদন্ত ছায়াতেই থাকবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কোনও সংস্থা ছায়াতদন্ত করে যেই রিপোর্ট পাবে, সেটা তদন্তকারী অফিসারকে দেবে। কিন্তু তারা যদি মিডিয়ায় দেয়, আর পরে ডিবি অন্যটা পায়; তাহলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি হবে। মূলত তদন্তকারী কর্মকর্তাই মিডিয়াকে বলবেন, আমরা অমুক সংস্থা থেকে এই সহায়তা পেয়েছি। তাদের এই সহয়তার জন্য আমরা ঘটনাটি উদঘাটন করতে পরেছি। হত্যাকাণ্ড হয়েছে এটা উদঘাটন করা আইনশৃঙ্খা বাহিনীর, এটা নিয়ে কারও আগ বাড়িয়ে কথা বলা ঠিক না।’

প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে তদন্ত করে উদঘাটন করছে, চার্জশিট দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি ফারদিন হত্যার ঘটনাও উদঘাটন হয়ে যাবে। তবে একটু সময় দিতে হবে।’