ঢাকার বারগুলো যেভাবে চলছে

জাগো বাংলা ডেস্ক প্রকাশিত: ০৭:৩৬ এএম, ০১ অক্টোবর ২০২২
ঢাকার বারগুলো যেভাবে চলছে

রাজধানীতে অবস্থিত কোনো বারই সময় ও নিয়ম মানছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, স্থানীয় থানা পুলিশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বারগুলোতে চলছে অনিয়মের মহোৎসব। থোড়াই কেয়ার হচ্ছে অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার।

গত ১৮ জানুয়ারি ‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০২২’ জারি করে সরকার। সেখানে অ্যালকোহল বা মদ উৎপাদন, কেনা-বেচা, পান করা, পরিবহন, আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি স্পষ্ট করা হয়েছে।

নতুন অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী, ২১ বছরের নিচে কেউ মদ পানের পারমিট পাবেন না। বিধিমালায় অ্যালকোহল জাতীয় মাদকদ্রব্য কোথায় বেচা-কেনা হবে, কোথায় বসে মদ পান করা যাবে, পরিবহন করা যাবে কি না— এসব বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। যা এতদিন অলিখিতভাবে চলছিল।

বিধিমালা অনুযায়ী, অ্যালকোহল আমদানি, রপ্তানি, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয় ও সংরক্ষণের জন্য পারমিট, লাইসেন্স বা পাস গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় পানের জন্য পারমিট আর পরিবহনের জন্য পাস বাধ্যতামূলক।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা জানান, বিধিমালা না থাকায় অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। পারফিউম স্যানিটাইজার তৈরিতে কিংবা শিল্পে ব্যবহৃত অ্যালকোহল খেয়েও মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দেশে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮’ থাকলেও কোনো বিধিমালা ছিল না। মূলত, ১৮৫৭ সালের ম্যানুয়াল বিধিমালা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।

তার দাবি, ‘বদলেছে সময়, মানুষও বেড়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নানা কারণে প্রচুর বিদেশি বাংলাদেশে আসছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। ফলে অ্যালকোহলের চাহিদা বাড়ছে। এই খাত থেকে সরকারের অনেক রাজস্ব আদায়ের সুযোগ আছে এবং তা নিয়েই এখন কাজ চলছে।’

বনানী এলাকার সিসা বার বা লাউঞ্জগুলো থেকে প্রতি মাসে পুলিশের অসাধু কর্তাদের পকেটে ঢোকে ৩৩ লাখ টাকা। প্রায় একই অঙ্কের টাকা যায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের কাছে। সবমিলিয়ে বনানী এলাকা থেকে সিসা লাউঞ্জ থেকে উৎকোচ আদায় হয় ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা

নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, ২১ বছরের নিচের কেউ মদ পানের পারমিট পাবেন না। মুসলিম হলে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পদমর্যাদার চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র লাগবে। হোটেল, রেস্তোরাঁয় অ্যালকোহল সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও পরিবেশনে অর্থাৎ বার স্থাপনে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যাবে। কোনো এলাকায় ১০০ দেশি বা বিদেশি মদের পারমিটধারী থাকলে অ্যালকোহল বিক্রির লাইসেন্স দেওয়া যাবে।

পারমিট নিয়ে রেল, সড়ক, নৌ ও আকাশপথে অ্যালকোহল পরিবহন করা যাবে। পারমিটধারী সদস্যরা ক্লাবের নির্ধারিত স্থানে বসে মদ পান করতে পারবেন। কোনো ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে ২০০ অ্যালকোহল পারমিটধারী থাকলে তাদের বার স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া যাবে। সংখ্যা আরও বেশি হলে চাহিদার ৪০ শতাংশ অ্যালকোহল আমদানি করা যাবে।

ইপিজেড, থিমপার্ক বা সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে যেখানে বিদেশি নাগরিক অবস্থান করবেন সেখানে বার স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া যাবে। হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, ডিউটি ফ্রি শপ ও প্রকল্প এলাকায় নির্দিষ্ট সংখ্যক বার স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া যাবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজ বাসায় মদ পান করতে পারবেন। বিদেশি মদ আমদানি বা রপ্তানির জন্য আবেদন করা যাবে। পর্যটন কর্পোরেশন, বার বা সরকারের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ অ্যালকোহল আমদানি করতে পারবেন না।

‘অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২২’এবং নতুন পাস হওয়া ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮’ এর তোয়াক্কা করছে না ঢাকার ক্লাব, হোটেল, রেস্তোরাঁর বারগুলো। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মেট্রো উত্তর এলাকায় ৬৬টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১০৫টি বারের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে ক্লাব ২১টি, রেস্টুরেন্ট ২৯টি ও হোটেল বার ৫৫টি। অন্যদিকে, ঢাকা মেট্রো দক্ষিণে ১৮টি বারের লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে হোটেল বারের অনুমতি রয়েছে চারটির, রেস্টুরেন্ট তিনটি ও ক্লাব বার ১১টির।

সর্বোচ্চ বারের অনুমতি পাওয়া হোটেল রিজেন্সি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত নাচ-গান বা ডিসকোর তালে তালে মদের গ্লাস বা বোতল হাতে মাদকসেবীদের উন্মাদনা। রাত ৩টার পর হোটেলটির ‘ক্লাব থার্টিন’ বন্ধ হলেও খুলে যায় অন্য জগৎ। এর ষষ্ঠ তলায় চালু হয় সিসা বার। যেখানে আড্ডায় বসেন ধনাঢ্য পরিবারের তরুণ-যুবকরা, বাদ যান না বয়স্করাও৷ অথচ বিকেল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বার চালু রাখার নিয়ম।

বারে যেমন নিয়ম নেই নাচ-গান বা ডিসকোর, তেমনি পারমিটধারী ছাড়া অন্য কারও নেই প্রবেশাধিকার। কিন্তু এই নিয়মের থোড়াই কেয়ার করছে হোটেল রিজেন্সি!

হোটেল রিজেন্সির মতো পরিবেশ না হলেও আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘনে পিছিয়ে নেই রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত হোটেল পূর্বানী’র। সেখানে অশ্লীল নাচ ও গানের তালে তালে চলে মাদকসেবীদের মাতলামি। পিছিয়ে নেই পল্টনের ফারস হোটেল, কাকরাইলের হোটেল রাজমণি। অথচ কোনো বারেই নাচ-গানের নিয়ম নেই।

অভিযোগ আছে, অধিকাংশ বারেই পারমিট কার্ড দেখা হয় না। বাংলামোটরের শেল, তেজগাঁওয়ের পিকক, শাহবাগের সাকুরা, বনানীর ব্লু মুন, গুলশানের লেকভিউ, বনানীর লোকই রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে সময় মানা হলেও কোনো মাদকসেবীর পারমিট কার্ড যাচাই করা হয় না।

রাজধানীর তেজগাঁও থানার পাশে অবস্থিত পিকক রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার। সেখানে গিয়ে কথা হয় এক মাদকসেবীর সঙ্গে। তিনি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কোনো কারণ ছাড়াই আমি মদ পান করি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সেই স্কুলজীবন থেকে আমি মাদকে আসক্ত। এখন নিয়মিত না হলেও কখনও বিয়ের আসরে, কখনও বন্ধুদের নিয়ে ইনডোর অনুষ্ঠানে মদ পান করি।’

অথচ তার মাদক সেবনে নেই বৈধতার সনদ। পারমিট ছাড়া মদ পান উচিত কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই পারমিট নিয়ে মদ পান করা উচিত। এটা তো নিষিদ্ধ নয়। শর্তসাপেক্ষে মদ পান ও বার পরিচালনার ক্ষেত্রে পারমিট থাকা দরকার। এটা হলে বাংলাদেশে কতজন মদ পান করেন, কয়টি বৈধ বার পরিচালিত হচ্ছে তার হিসাব সরকার জানতে পারবে।’

ঢাকার বারগুলোতে পারমিট কার্ড দেখা হয় কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত তিন মাসে আমি অন্তত এক ডজন বারে গিয়ে মদ পান করেছি। কিন্তু কোনো বারই আমার পারমিট কার্ড দেখতে চায়নি। পারমিট কার্ড শো করতেও হয়নি। আসলে আমার তো পারমিট কার্ড নাই। আমার মতো ৯৫ শতাংশ মাদকসেবী এভাবে পারমিট ছাড়া বারে গিয়ে নির্বিঘ্নে মদ পান করছেন।’

অভিযোগ আছে, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীতে অবৈধ সিসা লাউঞ্জ পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে সিসা থেকে ইয়াবা পর্যন্ত সেবন ও বিক্রি হচ্ছে। বড় অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে বনানী থানার ওসি নূরে আজম মিয়া ও এসআই শাহীন এক্ষেত্রে অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ।

সম্প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের আইজিপি’স কমপ্লেইন মনিটরিং সেলে এ সংক্রান্ত অভিযোগ জমা পড়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, রাজধানীর বনানী, গুলশান, ধানমন্ডি ও মিরপুর এলাকায় সিসা বার বা লাউঞ্জ রয়েছে প্রায় অর্ধশত। এর মধ্যে শুধু বনানীতে রয়েছে ২২টি। এসব সিসা বার থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের উৎকোচ আদায় করে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তারা। বনানী এলাকার সিসা বার বা লাউঞ্জগুলো থেকে প্রতি মাসে পুলিশের অসাধু কর্তাদের পকেটে ঢোকে ৩৩ লাখ টাকা। প্রায় একই অঙ্কের টাকা যায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তাদের কাছে। সবমিলিয়ে বনানী এলাকা থেকে সিসা লাউঞ্জ থেকে উৎকোচ আদায় হয় ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা।

যোগাযোগ করা হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো-উত্তরের উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘পারমিট ছাড়া কেউ বারে যেতে পারবেন না, মদ খেতে পারবেন না— এমন নির্দেশনা আমাদের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া আছে। যদি কেউ আইনের ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে মাদকসেবী কিংবা বার কর্তৃপক্ষ উভয়ের অর্থ ও কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।’

“সিসা ‘খ’ শ্রেণির মাদক। এটা পরিচালনা ও সেবন আইনানুযায়ী দণ্ডনীয়। আমরা বেশকিছু সিসা বার বা লাউঞ্জের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আবারও তথ্য বা অভিযোগ পেলে অভিযান পরিচালনা করা হবে”— যোগ করেন তিনি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো-দক্ষিণের সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার শুভ বলেন, সকাল ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সিসা বার বা লাউঞ্জ চলার নিয়ম। তবে, বিশেষ ক্ষেত্রে লেট ক্লোজিং লাইসেন্সের আওতায় অনুমতি নিয়ে ২টা পর্যন্ত চালানো যায়।

‘সেখানে সফট মিউজিকের অনুমতি আছে। নাচানাচি বা ডিসকোর কোনো অনুমতি নেই। বারের সঙ্গে অনুমতি নেই স্পা সেন্টারেরও। বারগুলো নেগেটিভ কোনো কিছু করতে পারবে না। যেমন- নারী বা দেহব্যবসা, ডিসকো প্রভৃতি।’

পারমিট কার্ড ছাড়া মদ পান প্রসঙ্গে সুব্রত সরকার বলেন, ‘এটা ছাড়া কেউ মদ খেতে পারবেন না। পারমিট কার্ড দেখিয়ে একটি বারেই খেতে পারবেন, সব বারে বা সারাদেশে খেয়ে বেড়াতে পারবেন না। পারমিট মূলত নিকটস্থ বারের অনুকূলে দেওয়া হয়। কোনো বারই পারমিট কার্ড ছাড়া কাউকে প্রবেশ করাতে পারে না, বসে খাওয়া তো দূরের কথা। এছাড়া একসঙ্গে কতজন খেতে পারবেন সেটাও বারের অনুমতিপত্রে লেখা থাকে। এসব খুবই কঠোরভাবে মেইনটেইন করা হয়।’

শখের কোকিলদের নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বেশ বিপাকে পড়েছে। সংস্থার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বাংলাদেশে পারমিটধারী মাদকসেবীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত কমে, বাড়ে। এর সঠিক হিসাব নেই। তবে, যারা নিয়মিত মদ সেবন করেন তারা পারমিট নিয়েই বারে যান। কিন্তু অনেকেই আছেন শখের বসে বা বন্ধুদের সঙ্গে মিশে মদ খেতে বারে যান। এ সংখ্যাটাও কম নয়। এক্ষেত্রে আমরা ভর্ৎসনা করি, কখনও অর্থদণ্ড দিই। কাউন্সেলিং করি। সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন ভেবে অধিকাংশ সময় আমরা মামলা বা কারাদণ্ড দিই না।

এ বিষয়ে গুলশান পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি আমরাও বিভিন্ন সময় মাদকবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করি। গুলশান ও বনানী এলাকায় অনেকগুলো বার রয়েছে। এসব বারকেন্দ্রিক কোনো ধরনের অনৈতিক ও আইনসিদ্ধ নয় এমন কার্যক্রমের খবর পেলে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’